ভারচুয়ালি ইয়োর্স ।। বিক্রম অধিকারী

vy1‘হে ভগবান! কারও ফাগুন মাস আর আমার হা হুতাশ!’ পরাগ ফেসবুকে যেতেই ওর ফেসবুক ফ্রেন্ড রাজন্যা মৈত্রর স্টেটাস আপডেট মনিটরে ভেসে এল। রাজন্যার হা-হুতাশেও টপাটপ লাইক পড়তে থাকে। পরাগ জানে, মেয়েদের এই জাতীয় গভীর দুঃখে ভিজিয়ে লেখা স্টেটাস অনেকটা পোটাটো চিপসের প্যাকেটের মতোই ফাঁপা। এরপর শুরু হবে ছেলেদের তৈলাক্ত কমেন্টের ফোয়ারা। তবে এই কমেন্ট কথোপকথনে বেশ হাসির খোরাক পাওয়া যায়। ভাবতে-ভাবতেই উড়ালিয়া নামে এক বীরপুঙ্গবের কমেন্ট উড়ে এল, “রাজন্য, শয়তানটার নাম বলে, আমি ওকে আনফ্রেন্ড ও ব্লক করব। ওই ঘোড়েলটাকে শত্রু ভাবতেও ঘেন্না হয়!” অদ্ভুত সেনগুপ্ত কৌতুক করে কমেন্ট করলেন, “লাভ নেই দিয়ে গাল, ১০৯১ কারো ডায়াল।” এবার মেঘ-পালক নামে একজন নারীবাদীর কমেন্ট গর্জন, “পুরুষ মানেই কাপুরুষ। ওরা ভার্চুয়াল জগতেও নারী নিগ্রহ করে। বোন, পাষণ্ডটার নাম কী রে?” প্রতিবাদী পুরুষকণ্ঠ আগুনপাখির কমেন্ট হুঙ্কার করে ওঠে, “@পালক দেবী, কিছু পুরুষ মহাপুরুষও বটে। আপনার নারীবাদে নারী বাদ! এই জন্যই ইনটেলিলেডিস না বলে ইনটেলিজেন্টস বলা হয়।” পরাগ বুঝতে পারে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কমেন্ট-ক্যাচাল চলতে থাকে। অবশেষে লড়াই থামে অদ্ভুতদার কমেন্ট, “খেয়ে ছ্যাঁকা, সবাই একা!” আবার কমেন্ট-“আড্ডা রাইট ট্র্যাকে। অয়নের লেখা কমেন্ট উঠে এল, “হুম…লাভ লসের ছড়াছড়ি!” এবার পরাগ কমেন্ট টাইপ করে, “প্রেম মেড ইন চায়না হোয়ো সাবধান/ প্রেমের পেইন কিন্তু মেড ইন জাপান!” ডিজিটাল দেবদাসের হতাশ বাণী ভেসে আসে, “শুরু কফিশপে, শেষ ওয়াইনশপে।” মাতন খ্যাপার দৃপ্ত কমেন্ট, “মদ মানুষের শত্রু, যে শত্রুকে ভয় পায় সে কাপুরুষ- বন্ধু, চিয়ার্স!” ইচ্ছেঘুড়ির কমেন্ট আড্ডার মেজাজে জল ঢালে, “দেবদাস ও খ্যাপা ভাই, ফুচকার দোকান দিলেই পারেন। পারো-চন্দ্রমুখীর ঝাঁক ঘিরে থাকবে!
রাজন্যার স্টেটাসে লাইক ইতিমধ্যে একশো ছাড়িয়েছে, কমেন্ট ও পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। রাজন্যা কিছুক্ষণ পরপর কমেন্টগুলোতে লাইক ক্লিক করে যাচ্ছে। ওর দুঃখের কারণ এখনও সাসপেন্সে মোড়া। এবার আসরে হাজির ব্রাজিলের রিজোলিনি রচা। ব্রাজিলিয়ান সুন্দরীর খাটি বাংলা কমেন্ট, “অভিনন্দন! রাজন্য, আপনি এত ভাগ্যবান। চুম্বন, চুম্বন!” রাজন্যার ঘোর সর্বনাশেও রিজোলিনির অভিনন্দন ও চুম্বন পাঠানোর কারণ পরাগ বুঝতে পারে। ফেসবুকে ব্রাজিলিয়ান বান্ধবীদের সঙ্গে চ্যাটের সময় ওর এরকম অভিজ্ঞতা কয়েকবার হয়েছে। রিজোলিনি গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে রাজন্যার বাংলা লেখা স্টেটাস পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করেছে। অনুবাদের পর যার অর্থ বদলে হয়েছে, “হে পালনকর্তা! এই হা-হুতাশ মাসে ফাগুন!” রাজন্যার অশ্রুভেজা স্টেটাসটা রিজোলিনির কমেন্টে পেইনলেস হওয়ার জোগাড়! বাধ্য হয়ে রাজন্যা হা-হুতাশের কারণ লিখে জানায়, “আমার প্রাণপ্রিয় কুকুরছানা ‘ঘেউ’কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফোটো আমার ফেসবুক কভার ফোটোতে আছে। কেউ খোঁজ পেলে জানিও, প্লিজ।” এবার বাংলাদেশের কবিবন্ধু নীলশালু, ঘেউ-বিয়োগ নিয়ে দুঃখ-ভেজা কাব্যিক কমেন্ট ভাসিয়ে দিলেন, “বোধ হয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর!” এবার রাজন্যার করুণ আর্তি, “দোহাই নীলদা, এরকম কুকথা বলবে না। আমি ঘেউ-কে না পেলে আত্মহত্যা করব।” পরাগ ভাবে, পারফেক্ট ন্যাকামণি! তবুও সুন্দরী বান্ধবী বলে কথা, একটা মোক্ষম কমেন্ট লিখতেই হয়, “তোমাকে দিলাম একটা পাপ্পি, তোমার বন্ধুকে একটা পাপ্পি, বন্ধুর বন্ধুকেও একটা পাপ্পি। আর কেউ বাকি আছে? আজ আমার ডগি ১০টা পাপ্পি জন্ম দিয়েছে।” তক্ষুনি পরাগের কমেন্টে লাইক করে রিজোলিনির কমেন্ট, “এবার বুঝতে পারলাম।” ওই ব্রাজিলিয়ান সুন্দরী কী বুঝলেন, তা পরাণের বোধগম্য হল না।
পরাগ নিজে একটা ফোটো পোস্ট করে ল্যাপটপ নিয়ে গোলার্ধের সুদূর দুই প্রান্তে যুবক-যুবতী, সঙ্গে ক্যাপশন, “সামহোয়্যার ইন দিস ওয়ার্ল্ড, দেয়ার ইজ ওয়ান পার্সন হু ইজ পারফেক্ট ফর ইউ… ইউ’ল অলমোস্ট সারটেনলি নেভার মিট।” ছবিটা পোস্ট করে পরাগ অনেককে ট্যাগ করতে থাকে। জানে ওর পোস্ট হাতে গোনা দু-একটা লাইক পাবে আর জুটলে দু’-একটা লাইক পাবে আর জুটবে দু’একজন কবি-বন্ধুর গতে বাঁধা রুটিন কমেন্ট। কিন্তু মেয়েরা যদি বোকা-বোকা স্টেটাসও লিখে দেয়, “উফ, একটু আগে আকাশে একটা চাঁদ দেখেছি, কী সুন্দর!” অথবা, “মন খারাপ, আমার সুন্টুনি-মুন্টুনি মিয়াও-এর জ্বর” কিংবা, “উফফ… মম… আচার খাচ্ছি।” তবুও শুরু হবে লাইক-কমেন্টের বন্যা। কে বলে মহিলারা সমাজে অবহেলার শিকার! আর ছেলেরা যতই কাব্যিক স্টেটাস লিখুক, জুটবে নগণ্য কিছু লাইক-কমেন্ট। বাধ্য হয়ে লাইক-লোভী ছেলেরা নিত্যনতুন পন্থা উদ্ভাবন করে। একদিন ত্রিপুরার ইমেল নামে একজন বেশ মজার স্টেটাস লিখেছিল, “জ্বলে-পুড়ে খাক আমি আজ খুব একা প্রেমিকা দিয়েছে ভাই গনগনে ছ্যাঁকা! খুশি হলে লাইক মারুন, দুঃখ পেলে কমেন্ট করুন।” কাল পরাগ স্টেটাসে লিখেছিল, “বিশেষ-বিশেষ সংবাদ! আত্মঘাতী এক যুবক তার যমজ ভাইকে খুন করেছে।” কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটা কমেন্ট পড়ে। ভ্যাংচানো ইমো দিয়ে কমেন্ট করে অনিকেত হাড় পিত্তি জ্বালিয়ে দেয়, “কী রে, তোর যমজ ভাই আছে বুঝি?” সঙ্গে সঙ্গে অনিকেতের কমেন্টে কিছু লাইক পড়ে। বাধ্য হয়ে পরাগ নিজের লেখা স্টেটাসটা ডিলিট করে দেয়। বন্ধুমহল ও পাড়াতে পরাগের একালষেঁড়ে বলে বদনাম আছে। সবসময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। কিন্তু ফেসবুক-অরকুটে এর ব্যাপক স্টেটাস, বেশ পপুলার ও কমেন্টবাজ, অনেকে ওর কবিতার মুগ্ধ পাঠক। উইটি কমেন্ট দেওয়ার জন্য ফেসবুকে ওকে অনেকে কমেন্ট কিং বলে। কমেন্ট পাওয়ার জন্য ওর ফেসবুক ওয়ালে রোজ গাদাগাদা পোস্ট জমা হয়। ফেসবুকে ওর বন্ধুর সংখ্যা চার হাজার দুই-ছুঁই। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে বন্ধুরা। অনেকের সঙ্গেই চ্যাট হয়। এ বিদেশিনীদের সঙ্গে চ্যাট করতে খুব ভালবাসে। প্রিয় কয়েকজন বিদেশিনীর সঙ্গে ভিডিও চ্যাটও হয়। যেমন রাশিয়ার তাতিয়ানা পাভলোভা, হাঙ্গেরির আইরিন গংগো, মেক্সিকোর পতিরা আলমিড়া, ব্রাজিলের বেহ মারাইস, পাকিস্তানের জারা তবাসুম। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ভাষার কোনও সমস্যা হয় না। কারণ আছে অনলাইন ট্রান্সলেটর। ইংরেজিতে লিখে ওর কথা চাহিদা মতো যে কোনও ভাষাতে অনুবাদ করে নেওয়া যায়।
পরাগের বুকে আচমকা একটা খুশির ঢেউ, একটা রিকোয়েস্ট নোটিফিকেশন এসেছে-রিজোলিনি রচা পরাগের পোস্ট করা ছবিটি নিজের টাইম লাইনে ট্যাগ করতে চায়। পরাগ দ্রুত ওকে ছবিটায় ট্যাগ করে দেয়। ছবির নীচে ভেসে এল ট্রান্সলেটর দিয়ে অনুবাদ করা রিজোলিনির বাংলা কমেন্ট, “দু’জনের হৃদয় পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত হলে দূরত্ব কোনও ব্যাপার নয়।” উৎফুল্ল হয়ে রচার কমেন্ট লাইক করে পরাগ কমেন্ট টাইপ করে, “@রিজোলিনি ম্যাম, ঠিক বলেছেন! দু’জন প্রকৃত বন্ধুর কাছে কোনও দূরত্বই অগম্য নয়।
বেথ মোরাইসের সঙ্গে চাটের সময় পরাগ জানতে পেরেছে, ব্রাজিলিয়ানরা ‘আর’কে ‘এইচ’ উচ্চারণ করে ওরা রিজোলিনি রচা’কে ‘হিজোলিনিহচা’ উচ্চারণ করবে।
‘হিজোলিনি’ বাঃ, নামটা তো বেশ পোয়েটিক। পরাগ জানে এটাই বিদেশিনীর আসল নাম হবে। ব্রাজিলিয়ানরা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বাঙালিদের মতো ছদ্মনাম বেশি ব্যবহার করে না। পরাগ মারকাটারি দেখতে হিজোলিনির প্রোফাইল ঘাঁটতে থাকে। হিজোলিনি ব্রাজিলের সান্তা কাতারিনা প্রদেশের জয়েনভিল শহরে থাকে। সদ্য কলেজ শেষ করেছে, বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করেন। ওর হিজল গভীর চোখে আগ্রাসী দ্যুতি, মুক্তোঝরা হাসি, শরীরের রোদেলা রং থেকে লাবণ্যের বিকিরণ। এর প্রত্যেকটা ফোটো পরাগ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দ্যাখে। ভগবান ওকে খুব যত্ন করে বানিয়েছেন, ওর সাহসী পোশাকের বাঁধ ভেঙে রূপ যেন উথলে পড়ছে। পরাগের মাথা ঝিমঝিম করে, হিজোলিনিকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠায়। ভারতীয় মেয়েদের তুলনায় ব্রাজিলের মেয়েরা বন্ধু হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদার। হিজোলিনি ওর অনুরোধ গ্রহণ করে। মনিটর ভেসে ওঠে ওর জবাব, ধন্যবাদ, চুম্বন! ভারতে চুম্বন এখনও অশালীনতার সীমা পেরোতে পারেনি, কিন্তু ব্রাজিলের বান্ধবীরা খুশি হলেই চুম্বনে ভরিয়ে দেয়, হোক না তা ভারচুয়াল। হিজোলিনিকে ও প্রত্যুত্তরে লিখে পাঠায়, “আমার পৃথিবীতে তোমাকে স্বাগতম!”
হিজোলিনির সঙ্গে পরাগের কমেন্টের মাধ্যমে কুশল বিনিময় চলতে থাকে। পরাগ এর সঙ্গে চ্যাট করার জন্য একটা বুদ্ধি খাটায়। একদিন হিজোলিনির মেসেজ বক্সে লিখে পাঠায়, ‘তুমি। আমার মেসেজ বক্সে ‘আই লাভ ইউ’ লিখে পাঠিয়েছ কেন?” সঙ্গে-সঙ্গে পরাগের পিসি স্ক্রিনে চ্যাট উইন্ডো ভেসে ওঠে। হিজোলিনি ওকে লিখে পাঠায়, “প্রিয় পরাগ, বিশ্বাস করো, সত্যি বলছি, আমি তোমার মেসেজ বক্সে কোনও টেক্সট করিনি।”
“দুঃখিত। আর বোলো না, অন্য একজন মেয়ে ওটা পাঠিয়েছিল। আমি ওকে মেসেজ করার বদলে ভুল করে তোমাকে মেসেজ করেছি।”
“বুঝলাম, তুমি সুপুরুষ আর সেক্সি, যে কোনও মেয়েই তোমার প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য।”
“মোটেই না। তুমি তো অপরূপা সাম্বা সুন্দরী!”
“আমি তোমাকে ভালবাসা জানালে তুমি কি রাগ করতে?”
“সেটা তো আমার পরম সৌভাগ্য হত। সত্যি বলতে আমার অবস্থা এখন লাভ অ্যাট ফাস্ট চ্যাট!”
“সৌভাগ্য আমার! তোমাকে এক গ্যালাক্সি ভালবাসা ও আলিঙ্গন পাঠালাম। চুম্বন! চুম্বন!”
“ঠিক আছে, তোমার শিশির ভেজা দু’টি ঠোটের একটি চুম্বন আমাকে ধার দিয়ো, আমি সুদ সমেত ফেরত দেব।”
“তোমার ঠোঁটের স্বাদ নেওয়ার জন্য আমিও ব্যাকুল হয়ে আছি।”
ধীরে-ধীরে পরাগ-হিজোলিনির সখ্য গভীর হয়। আগে পরাগ অফিস থেকে ফিরে সন্ধে সাতটার পর বন্ধুদের আড্ডায় যেত, বাড়ি ফিরত রাত দশটার পর। এখন অফিস থেকে ফিরেই সন্ধে সাতটার মধ্যে কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়ে। তখন জয়েনভিলে সকাল সাড়ে দশটা। হিজোলিনি বাড়িতে একা থাকে, ওর বাবা-মা দু’জনেই অফিসে। দুজনে মিলে জম্পেশ চাট আড্ডা চলে। ফেসবুকের মধ্যে কখন যেন রিয়েল পরাগ হারিয়ে যায়, ও নিজেও বুঝতে পারে না। ও এখন ভারচুয়াল পরাগ। এখন হিজোলিনিকে ও লিনি নামে সম্বোধন করে। ওর কাছ থেকে পরাগ ব্রাজিলের অনেক কিছু জানতে পারে। ওখানকার মেয়েরা সুন্দরী হওয়ার জন্য হামেশাই কসমেটিক সার্জারি করে থাকে, পৃথিবীর সেরা সুস্বাদু কফি ব্রাজিলে উৎপন্ন হয়। ব্রাজিলে ভোট প্রদান করা বাধ্যতামুলক। লাসানিয়া-ফিজোদা-ভাটাপা-কারুরু-টাকাকা প্রভৃতি সুস্বাদু ডিশ আস্বাদনের জন্য লিনি একে ব্রাজিলে আমন্ত্রণ জানায়। সঙ্গে থাকবে ব্রাজিলিয়ান রাম, কাশাসা দিয়ে তৈরি ক্যাপিরিনহা ককটেল! ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ সেখানকার কিছু পুরুষ বিয়ের পর স্ত্রীদের পদবি গ্রহণ করে। ‘হচা’ লিনির মায়ের পদবী। লিনির বাবা তাঁর স্ত্রীর পদবী নিয়েছেন। এখন লিনির কাছে পরাগ নিজেকে ‘পরাগ হচা’ নামে উপস্থাপন করে থাকে। অজান্তেই ওর প্রিয় খেলা ক্রিকেট থেকে ফুটবল হয়ে যায়। পরাগ বুঝতে পারে ওখানকার যুবতীরা ভারতীয়দের তুলনায় অনেক বেশি খোলামেলা পরিধানে অভ্যস্ত। লিনির ঘরোয়া স্বল্পবাসে ঢাকা উন্মত্ত আবেশে পরাগের ভিতরকার গহনা আমাজনের আদিম সত্তা প্রকট হতে থাকে। সারা দিন ঘোরে কাটে সন্ধের অপেক্ষায়।
আগামী জুলাইয়ে প্রতিবারের মতো শহরে গিনেস খ্যাত জয়েনভিল ডান্স ফেস্টিভ্যালের আসর বসবে। লিনি ওই অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে। ওর দল ব্রাজিলের ফ্রেভো লোকনৃত্য পরিবেশন করবে। পরাগের অনুরোধে ও ওয়েব ক্যামের সামনে নাচ প্র্যাকটিস করে দেখায়। নাচের প্রতিটি ছন্দে শরীরের পরতে-পরতে উৎপন্ন ঢেউ সাত সমুদ্র পার হয়ে পরাগের মনে সুনামি আনে। ওর লাস্যময়ী উন্মাদনায় পরাগের ভিতর বেজে ওঠে ধামসা-মাদল। নাচের উদ্দাম মদির আঁচে পরাগ বুঁদ হয়ে থাকে।
।। ২ ।।
আগামী বছর পরাগের সঙ্গে হিয়ার বিয়ে। পরাগ-হিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকে দুজন দু’জনের কাছে এসেছিল। দুজনেই কবিতা ভালবাসে। পরাগ ওকে নিয়ে প্রতি রবিবার ছোটখাটো আউটিংয়ে যায়। প্রতি রাতে ফোনে অনেকক্ষণ ধরে কথা হয়। ও হিয়াকে মাঝেমাঝে হিজোলিনির কথা বলে। কিছুদিন ধরে হিয়া লক্ষ করে, পরাগ ইদানীং ওর প্রতি উদাসীন, সবসময় ব্যস্ততার ভান করে। আড্ডায় যায় না, রাতে মোবাইলের সুইচ বন্ধ রাখে। বাড়িতে সবার চোখে পরাগের অদ্ভুত আচরণ ধরা পড়ে। দাদা-বউদি-অশীতিপর ঠাকুমা নিয়ে ওদের পরিবার। পরাগ সবাইকে বলে, “অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ, তাই বাড়িতে কাজ নিয়ে আসতে হয়।” বউদি লক্ষ করেন, পরাগ রোজ সন্ধেয় খুব পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে নিজের ঘরে গিয়ে ঘর বন্ধ করে দেয়। রাতের খাবার নাকে-মুখে গুঁজেই আবার ঘর বন্ধ। বিনিদ্র ক্লান্তি জড়ানো শরীরে ও সবসময় কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে, চোখের নীচে কালি দিন দিন প্রকট হয়। একদিন রাত দুটোয় বাথরুমে যাওয়ার সময় ঠাকুমা লক্ষ করেন, পরাগ অদ্ভুত ভাষায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।
পরদিন দুপুরে ঠাকুমা পরাগের বউদিকে ডেকে বলেন, “আমার কার্তিকের মতো নতিডারে পরি ধরছে।” বউদি হেসে ওঠেন। ঠাকুমা চোখ বড়-বড় করে দেশের বাড়ির গল্প শুরু করেন, “সুন্দর ছ্যারা দেখলেই পরি ধরে। আমি তখন খুব ছুডু আছিলাম। দেশের বাড়ি আছিল ময়মনসিংহের বনবাংলা গ্রামে। আমার লগের বাড়ির উদয়কাকা দেখতে খুব সুন্দর আছিল। উদয়কাকা দিন-দিন রুগা হইয়া যাইতাছিল। রাইত কইরা ঘুমাইত, সারা রাইত বন-বাদাড়ে ঘুইরা বেড়াইত। তারপর কোকিল গ্রামের থাইক্যা নামকরা নানু উঝারে ধইরা আনা হল। নানু উঝা গণা-পড়া কইরা কইল, কাকারে জলপরি ধরছে। পরে নানু উঝার তাবিজে কাকা ভালা হইছিল।” সব শুনে বউদি বলেন, “ঠিকই বলেছ ঠাম্মা, তোমার নাতিরে ডিজিটাল পরি ধরেছে! আমি ওঝাকে খবর দিচ্ছি।”
“আইজই খবর দে। দুগগা-দুগগা, আমার চাঁদের কণা নাতিডারে রক্ষা করো।”
বউদি হিয়াকে ফোন করে, “হিয়া, তোমার হিরোকে ডিজিটাল পরি ধরেছে। ব্যবস্থা নাও তুমি।”
সেদিন সন্ধ্যায় হিয়া পরাগের সঙ্গে বেরোয়। ওরা রেস্তরাঁয় বসে। হিয়া বলে, “আমি সেই কবে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, তুমি একসেপ্ট করছ না কেন?”
“আমি আগেই বলেছি, বিয়ের পর তোমাকে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড বানাব।” এবার হিয়া গর্জে ওঠে, “এখন বানালে কি রাত জেগে নষ্টামি করতে অসুবিধে হবে? রাতে মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে রাখ কেন?
হিয়ার মুখে নষ্টামি শব্দটা বড্ড বেমানান লাগে, রাগে পরাগের সারা শরীর রি-রি করতে থাকে। দাপটের সঙ্গে বলে, “কেন, রাত জেগে তোমার সঙ্গে বোকা বোকা কথা বলে যেতে হবে?”
“অবশ্যই। হবু স্ত্রীর সঙ্গে ফোনচুয়াল সম্পর্ক সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। অন্য নারীর সঙ্গে ভারচুয়াল সম্পর্ক মানে ঘোর পাপ।”
“আমার মনে পাপ নেই।”
“ঠিক আছে, তোমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড আমাকে দিতে পারবে?”
“বিয়ের আগেই এত খবরদারি? ছিঃ ! তুমি সত্যি খুব ছোট মনের!”
“আমি ছোট মনের? আর তুমি বড় মন নিয়ে রাত জেগে নোংরামি করে যাবে? আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”
“ঠিক আছে, নোংরা ছেলে তোমার জীবন থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে!” পরাগ বাইক নিয়ে হাওয়ার বেগে চলে যায়।
বাড়ি ফিরে পরাগ কম্পিউটারে বসে। ফেসবুকে গিয়ে বুঝতে পারে লিনি অনেকক্ষণ ধরে ওর জন্য অনলাইনে অপেক্ষা করছে। ও ভিডিয়ো চ্যাট অন করে চুপ করে থাকে। ওর মেঘলা মুখ দেখে লিনি বুঝতে পারে কোনও অঘটন ঘটেছে। লিনি ওকে লিখে পাঠায়, “প্রিয়, তোমার মন খারাপ কেন?”
“আমার খুব কাছের জন আমাকে নোংরা ছেলে বলছে।”
“তোমার কোনও বান্ধবী?”
“না, তুমি ছাড়া আমার কোনও বান্ধবী নেই।”
“প্রিয় পরাগ, এত দূর থেকে আমি তোমার খুশির জন্য কী করতে পারি?”
“একটা জিনিস চাইলে দিতে পারবে।”
“আমার ভালবাসার জন্য আমি সব করতে পারি।”
“লিনি, রাগ করবে না তো?”
“আরে বন্ধু, কী চাই, একবার বলেই দ্যাখো না।”
“আমি তোমাকে নিরাবরণ ইভের রূপে দেখতে চাই।”
“ঠিক আছে, আমার আদমের জন্য আমি ইভ হতে রাজি।” ওয়েব ক্যামের সামনে সব আবরণ মুক্ত করে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয় লিনি। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকা রাজকন্যা যেন সব গোপন রহস্য উজাড় করে পরাগের কম্পিউটারের স্ক্রিনে ধরা দেয়। আদিম ইভের রমণীয় ফ্রেভো নাচের মাদকতায় বিভোর পরাগের ধমনীতে যেন আগুন স্রোত, সেই আগুনে হিয়ার বিচ্ছেদ ব্যথা জ্বলে নিঃশেষ। এখন ওর দিনগুলো স্থবির, সন্ধের পর মাতাল সময় ছোটে আলোর বেগে।
একদিন পরাগ ফেসবুকে গিয়ে দেখতে পায় লিনি ওকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে। ওর মন দুমড়ে-মুচড়ে যায়— লিনি কোনও কারণ ছাড়াই ওকে ছেড়ে গেল! ঠিক কী কারণে তিনি নিজের দুনিয়া থেকে পরাগকে ছেঁটে ফেলল তা জানার জন্য ও লিনি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সার্চ করে, কিন্তু ওকে খুঁজে পায় না। ও বুঝতে পারে, লিনি ওকে ব্লক করে দিয়েছে। ফোন করলেও ধরছে না, যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ। সুদূর আমাজন নদীর রাক্ষুসে পিরানহা যেন নিমেষে এর ভারচুয়াল ভালবাসা সাবাড় করে দেয়।
ভারচুয়াল জগতটা অদ্ভুত, যাকে কোনওদিন পাওয়াই হয়নি, তাকে হারানোর সুতীব্র যন্ত্রণা পরাগকে জীবন্ত লাশে পরিণত করে। একদিন পরাগ বলেছিল, “তোমার সঙ্গ পেলেই সময় আলোর বেগে শেষ।” জবাবে লিনি জানিয়েছিল, আমরাই শেষ হয়ে যাব, সময় থেকে যাবে।” ভারচুয়াল জগতে কাকে যেন খুঁজতে খুঁজতে পরাগ নিজেই কখন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। আজ ওকে খোঁজার জন্য হিয়া নেই। ও ছাদে যায়, আকাশে তাকিয়ে প্রার্থনা করে, “ঈশ্বর, আমার সব অপ্রাপ্তি জমিয়ে ওই নিঃসঙ্গ চাঁদকে আরও মোহময় করো, যে অনন্তকাল লিনিকে আমার আকাশে উজ্জ্বল রাখবে।”
অনেকদিন পর পর ফেসবুকে বসে। কম্পিউটারে সেভ করে রাখা লিনির ছবিগুলো দ্যাখে। লিনি ওর কাছে এখন শুধুই ছবি। আজ অনেকদিন পর ও ফেসবুকে একটা ফোটো পোস্ট করে। নিশুতি রাতে রাতজাগা একটা পাখি আর আকাশে নিঃসঙ্গ চাঁদ। সঙ্গে নিজের লেখা চার লাইন, “ডিজিটাল দুনিয়ায় ভারচুয়াল হয়ে যাই। এক আকাশ দূরে থাকো, ফেসবুকে পাশে পাই! মাঝে আছে তেরো নদী, ওয়েব ক্যামে হয় দেখা/ রাতে চাঁদ ডেকে বলে, তুই আমি বড় একা।” ছবিটায় অনেককে ট্যাগ করে। অনেকদিন পর একে পেয়ে বন্ধুরা ছবিটি লাইক ও কমেন্টে ভরিয়ে দেয়। সুমিত্রাদির কমেন্ট ভেসে আসে, “অনেকদিন পর এলে, এতদিন কোথায় ছিলে?” অদ্ভুতদার কমেন্ট উঠে আসে, “তোমার পোস্ট চেটেপুটে পড়ি। পোস্ট তো নয় যেন ঝালমুড়ি!” কবি বান্ধবী শিশিরকণা লিখে পাঠায়, “চোখের জলে জলের বোমা, জলের বোমায় হিরোশিমা। জানো কি তুমি বুকের মাঝে, অনেক কান্না আছে জমা?” অধরা মন নামে একজনের কমেন্ট ভেসে এল, “কিছু সুখ হারানোয়, কিছু সুখ পাওয়াতে। কিছু সুখ স্মৃতিময়, কিছু ভুলে যাওয়াতে।” অনিকেতের কমেন্ট আসে, “দিনের মলাট উলটে দ্যাখো, রাতের পাতায় তার নাম লেখা।” কল্যাণের হাড়-জ্বালানো কমেন্ট কম্পিউটারের পর্দায়, “আবার বুঝি খেয়েছে ছ্যাঁকা?” এবার বাংলাদেশের বন্ধু নস্টালজিক কমেন্ট করে, “পরাগ ভাই, কাটা ঘায়ে চিনির ছিটা দিলাম! ছ্যাঁকা জুড়াইতে বার্নল লাগান।” নস্ট্যালজিকের কমেন্ট লাইক করে অক্টোপাসের একগাদা হাসির ইমো-সহ কমেন্ট পাঠায়, “ঘুমিয়ে আছে কুবের মাঝি সব প্রেমিকের অন্তরে।” পরাগ সবার কমেন্টে লাইক বাটন ক্লিক করে। পরাগের পোস্টে অনেক লাইক ও কমেন্ট পড়েছে। মেয়েদের পোস্টেই লাইক-কমেন্ট বেশি পড়ে, এটা সবসময় সত্যি না। ওর মতো ভারচুয়াল হিরোর ক্ষেত্রে লাইক-কমেন্ট আসতে বাধ্য। ও কমেন্টগুলো খুঁটিয়ে লক্ষ করে। কয়েকজন কমেন্ট করেছে, যারা এর বন্ধু নয়। এদের মধ্যে অধরা মন নামের মেয়েটির কমেন্টটি খুব পোয়েটিক। ঠিক কারও কবিতা থেকে ঝেঁপেছে। মেয়েটির প্রোফাইলে গিয়ে পরাগ লক্ষ করে, এক সুন্দরী মেয়ের মুখ নেকাবে ঢাকা। গভীর ব্ল্যাকহোল চোখ মেয়েটিকে আরও রহস্যময়ী করে তুলেছে। মেয়েটির প্রোফাইল কভারের ক্যাপশন, ‘আই ওয়ান্না বি ইয়োর ফেভারিট হ্যালো অ্যান্ড হার্ডেস্ট গুডবাই!’ ওস্তাদ ফেসবুকার হিসেবে পরাগ জানে, ফেসবুকে ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই ছেলেরা আদমি থেকে যেন ‘অ্যাড-মি’ হয়ে যায়। পুরুষ পঙ্গপালের উৎপাত থেকে বাঁচতে মেয়েরা নিজেদের সব ইনফো হিডেন রাখে। এরা অচেনা কারও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতে চায় না। প্রোফাইল ঘেঁটে বোঝা যাচ্ছে, অধরা মনের রুচি বেশ ভাল। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে ক্ষতি কী? পরাগ ওকে রিকোয়েস্ট পাঠায়।
পরের দিন সন্ধেবেলা পরাগ দ্যাখে, অধরা মনি বন্ধু হিসেবে ধরা দিয়েছে। ও অধরা মনের ওয়ালে গিয়ে টাইপ করে, “বন্ধু তোমায় শ্রাবণ দিলাম, ভাসাও মনের ভেলা/ বন্ধু তোমায় সকাল দিলাম, চলুক রোদের খেলা বন্ধু/ তোমায় দুপুর নিলাম, একটু ঘুঘু ডাকুক/ বন্ধু তোমায় রাত্রি দিলাম, স্বপ্ন বেঁচে থাকুক।” জবাবে অধরা মন লিখে পাঠায়, “অসামান্য লেখনী আপনার, কলম চলুক।” ওর সঙ্গে কমেন্টের মাধ্যমে টুকটাক কথা হয়। পরাগ বুঝতে পারে, অধরা মন ফেসবুকে আসে, কিন্তু অনলাইন হয় না। একদিন ও নোটিফিকেশন দেখে বুঝতে পারে, অধরা মন ফেসবুকে বসেছে। ও তখনই অধরা মনের মেসেজ বক্সে গিয়ে একটা কবিতা পেস্ট করে দেয়, “তোমার মুখোশের আড়ালে আছে, মেঘ চেরা রোদ সিঁথি, পিরামিড নাক, শিমুল লাল ঠোঁট, শ্রাবণ প্লাবিত চিবুক। কোকিল ডানায় প্রসারিত যুগল ভ্রূ, চেরাপুঞ্জি মেঘের মতো নেমে আসা চুল।” ওষুধ কাজে লাগে। এর পিসি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কাঙ্ক্ষিত চ্যাট উইন্ডো। অধরা মন লিখে পাঠায়, “আমাকে তুমি কোথায় দেখলে?” “স্বপ্নে দেখেছি! এবার অবগুণ্ঠন খোলো। গহন মেঘমায়ায় বিন বনছায়ায়… ”
“এই বেশ আছি, মুখোশ তো স্বস্তিকর আসল মুখের চেয়ে।”
“এই মন, তুমি কোথায় থাকো? তোমার আসল নাম কী?”
“আমি মনখেয়া গ্রামে থাকি! আমাকে যে নামে খুশি ডাকতে পার।”
“আচ্ছা, আমি তোমাকে মন বলব। আমি মনখেয়া গ্রামের মনপাখি হতে চাই, ঠিকানা বলো।”
“কাশফুলের আগমনী ভেলায় ভেসে রোদের ঠিকানায় চলে এসো।”
“ধুস, ফেসবুকে নয়, তোমার সঙ্গে ফেস টু সে কথা বলতে চাই। আর অধরা থেকো না।”
“ধরতেই হবে, এমন কোনও কারণ আছে কি? অধরা স্বপ্ন, চাঁদ, পাখি থাক না অধরাই থাকি। আমি তোমার অধরা স্বপ্ন হতে চাই। যা অনন্তকাল এক গভীর আনন্দ হয়ে তোমার মনে বেঁচে থাকবে।”
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে কাব্য দিয়ে পাব, স্বপ্ন দিয়ে ছোঁব, মন দিয়ে ধরব। আমাদের থাক বিনিসুতোর বাঁধন।”
“তোমার রিয়েল লাইফে কোনও বান্ধবী নেই?”
“আপাতত নেই। মন, তুমি কি রিয়েল লাইফে আমার বান্ধবী হবে?”
“জানো তো পরাগ, রিলেশনশিপে দুয়ের বেশি যাত্রী থাকলে শিপ ডুবে যায়।”
“আমি ভীষণ একা, তোমার ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া আমার জীবন ফ্রেন্ড ছাড়া ফেসবুক, লাইক ছাড়া স্টেটাস, ভিডিয়ো ছাড়া ইউটিউব, রেজাল্ট ছাড়া গুগল!”
“বুঝলাম, অতীতকালে ছিল কোকেন-নিকোটিন-অ্যালকোহল আর ডিজিটাল যুগে হয়েছে টুইটার-ফেসবুক-গুগল! রাত দশটা! আমাকে এবার যেতে হবে।”
“আমার ঘুম যাবে তোমাকে খুঁজতে, বালিশকে তাই নিঃসঙ্গতার গল্প শোনাবে অনিদ্রা। ইউ আর দ্য লাইট অফ মাই লাইফ, সুইট ড্রিমস।”
“পরাগ, ইউ টার্ন মি অন! টেক কেয়ার, বাই।”
কিছুদিনের মধ্যেই ওদের গভীরতা প্রগাঢ় হয়। পরাগের জোরাজুরিতে অধরা মন একদিন ভিডিয়ো চ্যাটে এসেছিল, কিন্তু মুখের আবরণ খোলেনি। এই অনলাইন ডেটিং-এর আবেশে লিনির দুঃখ চাপা পড়ে যায়। একদিন সকালে পরাগ ফেসবুকে গিয়ে দ্যাখে, অধরা মন মেসেজ করেছে, সকালের প্রথম সূর্যালোক, আদুরে রোদ্দুর, এক সতেজ ভোরে ঘ্রাণ তোমাকে দিলাম। পরাগ, আজ সন্ধেয় অনলাইন হতে একটু দেরি হবে, তুমি অপেক্ষা কোরো।” পরাগ জবাব দেয়, “তুমি সুপ্রভাত বললে আর অভিমানী মেঘ তরুণীর ধূসর ওড়নার নীচে আটকে থাকা আমার প্রজাপতি ভোর ডানা মেলল। মন তোমার সুগভীর বন্ধুতায় ধুলো-ময়লা ধুয়ে মুছে আমার মন ঝকঝকে হয়ে যায়।”
সন্ধেয় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অধরা মন অনলাইনে আসে। পরাগ ওকে লিখে পাঠায়, “সন্ধের হাত ধরে তুমি আস। তুমি আসলে হাসি মুখে চাঁদ আসে, সোনার নূপুর পায়ে চারদিক আলো করে।”
“বিকেলগুলো সন্ধ্যের ঘরে ঢুকলেই আমি তোমার সবুজ ঘ্রাণ পাই। এই পরাগ, জানো তো, আজ আমার জন্মদিন!”
“শ্রাবণ ছন্দে, বৃষ্টির আনন্দে মনের মাধুরী মিশিয়ে দিলাম। শুভ হোক তোমার জন্মদিন। তোমাকে দিলাম বৃষ্টি ফোঁটা, পড়বে কপাল মাঝে, মেঘবালিকা ঠোট বাঁকাবে অপূর্ব তোমার সাজে।”
“বাঃ! আমি আপ্লুত! এবার জন্মদিনের পাওয়া সেরা উপহার! বলো, তুমি কী চাও?”
“চাইলে দিতে পারবে?”
“বলো না কী চাও! বন্ধু, প্রাণটা চেয়ো না কিন্তু!” সুপ্ত আমাজন আদিম সত্তা পরাগের মনের গহিন চিলাপাতায় প্রকট হয়ে ওকে স্পর্ধা জোগায়। ও লিখে পাঠায়, “তোমার শরীরের প্রতিটি আয়নায় দৃশ্যায়িত হোক আমার আদম সময়।”
“মানে?”
“আমি তোমায় প্রকৃতির সৌন্দর্যে দেখতে চাই।”
“আরে বাবা, খুলে বলে, কী চাও।”
“সোনামনি, আমি আমার শুভ জন্মদিনে তোমাকে জন্মমুহূর্তের রূপে, নিরাবরণ দেখতে চাই…” পরাগের আকাশের চাঁদটাকে দপ করে নিভিয়ে অধরা মন অফলাইন হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে পরাগের ইনবক্সে একটা মেসেজ আসে। অধরা মন ওকে লিখেছে, “সবাই মৃত্যুকে কেন দোষ দেয়, প্রিয়জনই জীবন কেড়ে নেয়। পরাগ, তুমি দাবানল থেকে বেরোও। ওখানে যতটা না আগুন, তার চেয়ে বেশি ছাই। বাস্তব জীবনে এসো, জীবন অনেক সুন্দর। জাস্ট ফেস ইট, ডোন্ট ফেসবুক ইট। চ্যাট উইন্ডোতে তোমার লেখা আজকের বিকৃত বনজ বাসনার স্ক্রিনশট সেভ করে রাখলাম। ওটা ফেসবুকে পোস্ট করব। তোমার ভারচুয়াল চরিত্রের ময়লা দিকটা সবার কাছে প্রকাশ হবে। গণ কমেন্টের ধোলাইয়ে তোমার হৃদয়ের সব ধুলো-ময়লা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। মাথাটা রিফ্রেশ করে নাও। অলীক জীবন শেষ করতে কম্পিউটারের স্টার্টে ক্লিক করে ভারচুয়াল জগতটা লগ অফ করো। চির বিদায়ের ছলে এটাই হোক আমাদের চিরমিলন- ভারচুয়ালি ইয়োর্স, অধরা মন।”
নারীর মন সত্যিই অধরা। পরাগ সংবিৎ ফিরে পায়, এর কুপ্রস্তাবের বিষয়টা অধরা মন ফেসবুকে পোস্ট করলেই পরাগের ভারচুয়াল দুনিয়া নিমেষে ভ্যানিশ। সবাই ছি ছি করবে। অনেকে কমেন্টের মাধ্যমে থু থু ছোটাবে। তারপর হবে গণ-আনফ্রেন্ড। পরাগ দ্রুত নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেয়। হঠাৎ মনে পড়ে, আজ হিয়ার জন্মদিন। ইস, ভুলেই গিয়েছিল। সেদিন হিয়ার সঙ্গে খুব খারাপ বহার করেছে ফোন করতে সংকোচ হয়। পরাগ হিয়াকে এসএমএস করে, “হিয়া ডিয়ার, “জন্মদিনের অফুরান শুভেচ্ছা। প্লিজ আমার সব ভুল ভুলে যাও। তোমার জন্মদিনের শুভক্ষণে শুরু হোক আমাদের নতুন পথ চলা।”
বউদির কাছে হিয়ার ফোন আসে, “দিদি, তোমার দেওর এখন পরি-মুক্ত।” বউদি হেসে বলেন, “ভাই, তা পরিটার নাম কী গো?”
“লিনি পরি!”
“পরি তাড়ানো ওঝাটি কে?”
হিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, “অধরা মন!” বউদি লক্ষ করেন, পরাগের ঘরের দরজা খোলা… ঘর থেকে নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। ঘড়িতে তখন সবে রাত ন’টা…

মুখোশ ।। ইমরান হোসাইন ইমু

তিন দিন হলো নীলাকে দেখতে যাইনি। ব্যাপারটা আমার কাছে একই সাথে অবাক করার মত এবং দুঃখজনক। তিন দিন আগে তার সাথে ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এই ঘটনা সব মেয়ের জীবনে ঘটে না। যাদের জীবনে ঘটে, তাদের চক্ষুলজ্জার ভয়ে আড়ালে থাকতে হয়। নীলা আড়ালেই আছে। তিন দিন ধরে বিছানায় শোয়া। ভার্সিটিতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শুনেছি, কারও সাথে ঠিকমত কথা পর্যন্ত বলছে না। আমি গেলে তার ভাল লাগবে বলে মনে হয় না। বরং তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সে আমাকে দেখলেই রেগে যায়। মনীষীরা বলেন, ‘মেয়েরা যাকে ভালবাসে, তার উপরই রাগ করে।’ মনীষীদের এ বাণীটা আমার বেলায় খাটে না। নীলা আমার উপর শুধু রাগই করে, ভালবাসে না। তার দৃষ্টিতে আমি ‘বিরক্তিকর।’
এ অবস্থায় নীলার রাগ বাড়ানো উচিত হবে কি না তা নিয়ে ভাবতে-ভাবতেই তিন দিন কেটে গেছে। এত ভাবনার ফলস্বরূপ কোনও উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে নীলাকে নিয়ে ভাবতে আমার যেন কোন ক্লান্তিই নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর-এই একটা মেয়ের কথা চিন্তা করেই জীবন পার করে দিতে পারব। তবে তার আমাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। তার ভাববার মত অনেক কিছুই আছে। ভার্সিটি, বন্ধু-বান্ধব, ইংরেজি সাহিত্য, হেনরিক ইবসেন, জন কিটস, পরিবারের ছোট ভাইটার পড়াশোনা-এত চিন্তার মাঝে আমার কোনও ঠাঁই নেই। তার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে জানালা বন্ধ করে দেয়। ব্যাপারটা আমাকে মোটেও রাগায় না। বরং নীলার রাগী মুখ দেখে আমার হাসি পেয়ে যায়। দিনে কমপক্ষে একবারের জন্য হলেও নীলার দর্শন আমার জন্য বাধ্যতামূলক। তা না হলে আমার অস্বস্তির ভাব হয়। আজ টানা তিন দিন হতে চলল, অথচ একটা মুহূর্তের জন্যও নীলার দর্শন পেলাম না। যতটা ভেবেছিলাম, ততটা অস্বস্তিও লাগেনি। ব্যাপারটা অবাক করার মতই।

দুই

বেশ কিছুদিন আগের কথা। নীলা ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় আমি তার সামনে দাঁড়াই। একগুচ্ছ কচুরিপানার ফুল তার হাতে দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকি। নীলা ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। আমি হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে দ্রুতপদে হেঁটে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। সেরাতে নিয়মমাফিক আমি তার জানালার সামনে দাঁড়াই। জানালার একেবারে কাছে নয়। রাস্তার একপাশে জানালা, অন্য পাশে আমি। নীলা জানালার সামনে আসে। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে কাছে ডাকে। কোনওদিনও সে একাজটা করেনি। আমি হতভম্ব মুখে তার কাছে এসে দাঁড়াই। আমার দেয়া একগুচ্ছ কচুরিপানার ফুল সে আমার মুখে ছুঁড়ে মেরে বলে, ‘আর কোনওদিন বিরক্ত করবে না। জানালার পাশে দাঁড়াবে না।’
নীলা জানালা বন্ধ করে দেয়। আমি অসহায় মুখে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কচুরিপানার ফুলগুলো। তারাও যেন আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ব্যর্থ ফুল যেভাবে ব্যর্থ প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তবে নিয়ম করে নীলার জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার বন্ধ হয়নি। জানি, নীলাকে কোনওদিনও কাছে পাব না। পাব না জেনেও হয়তো অপেক্ষা করে যাওয়ার নামই, ‘ভালবাসা’।
এ ঘটনার পর নীলাকে কাছে পাবার ইচ্ছেটা আরও প্রবল হলো। তাকে নিয়ে দেখা এতদিনের স্বপ্নগুলোও যেন ঘটনার আকস্মিকতায় আরও গাঢ় হচ্ছে। ভালবাসা কিছুকিছু মানুষকে হিংস্র করে তোলে। এই কিছু-কিছু মানুষের মধ্যে কি আমি আছি?

তিন

নীলার বাসায় তাকে দেখতে এসেছি। নীলা বিছানায় শোয়া। চোখে-মুখে উদভ্রান্ত অভিব্যক্তি। তবুও এই বিমর্ষতার আড়ালে রয়েছে প্রাণোচ্ছল, হাসিমাখা এক পবিত্র মুখ। আমার দিকে ফিরে নীলা একটা ব্যর্থ হাসি দিল। সেই হাসিতে যে কতটা কষ্ট মিশে আছে, তা বোধহয় কোনও পরিমাপকেই পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমার পাশে নীলার বাবা-মা বসে আছেন। তাঁরাও অসহায় মুখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কোনও প্রাণ নেই।
আমি নীলার হাত ধরলাম। সে ভীষণ চমকে উঠল। আমি তার চমকে ওঠা টের পেলাম হাতের স্পর্শে। আমি নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে হতবিহ্বলের মত বিড়বিড় করছে।
আমি হাসিমুখে নীলার বাবা-মাকে বললাম, ‘আমি নীলাকে বিয়ে করব।’
হঠাৎ নিস্তব্ধতা। কারও মুখে কোনও কথা নেই। এই মুহূর্তটা অসাধারণ! পৃথিবী যেন নিথর হয়ে আছে। কান খাড়া করে ঘড়ির টিকটিক শোনার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনও শব্দ পাচ্ছি না। খুব সম্ভব, এই রুমে ঘড়ি নেই। নীলার বাবা হতভম্বের মত বললেন, ‘তুমি কী বললে?’
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘আমি নীলাকে বিয়ে করব।’
নীলা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকাল। প্রথমবার আমার কথাটা খুব সম্ভব তার কানে পৌঁছয়নি। তবে এখন পৌঁছেছে।
নীলার বাবা কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই জান, নীলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘জি। জানি।’
‘তবুও তুমি তাকে বিয়ে করবে?’
‘জি, করব।’
‘কেন?’
‘আমি নীলাকে ভালবাসি।’
নীলার চোখে জল চলে আসছে। ওর মা উঠে অন্য রুমে চলে গেছেন। তিনি একাকী কান্না করার মানুষ। নীলার হতবাক পিতা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে জল আসছে না। পুরুষ মানুষের কান্না কম।
আমি নীলার দিকে তাকিয়ে আছি। তার হাত আমার হাতে। আমার চোখে-মুখে বিজয়ের ছাপ। নীলার গাল জলে ভেসে যাচ্ছে। সেই জল মুছে দিতে গিয়েই আমার নিজের ভেতর খানিকটা অপরাধবোধ কাজ করল। এত ফুটফুটে একটা মেয়ের-কত ক্ষতিই না আমি করেছি! তার এই অবস্থার কারণ তো আমিই! নীলাকে পাব না জেনে কিছু লোক ঠিক করি। তাদের কাজ, নীলাকে ধর্ষণ করা। কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হয়ে গেলে তার জন্য উপযুক্ত তো দূরের কথা, সাধারণ পাত্রই খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক তখনই মহামানব সেজে আবির্ভূত হব আমি। বিয়ে করে নেব এই ধর্ষিতাকে। ভালবাসা কিছুকিছু মানুষকে হিংস্র করে দেয়। এই কিছু-কিছু মানুষের মধ্যে আমিও আছি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পেছন থেকে চোখে জল আর মুখে ভালবাসার হাসি নিয়ে নীলা আমাকে বলল, ‘তোমার দেয়া কচুরিপানার সবগুলো ফুল কিন্তু আমি ফেলে দিইনি। আমার কেন জানি ফুলগুলোর উপর ভীষণ মায়া হচ্ছিল। মানুষের উপর রাগ করা যায়, কিন্তু ফুলের উপর তো আর রাগ করা যায় না। তাই দুটো ফুল আমি খুব যত্ন করে আমার টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখেছি।
আমি নিজের গালে হাত দিয়ে কেঁপে উঠলাম। আশ্চর্য তো! আমার চোখে পানি আসছে কেন?

দাম্পত্য ।। চন্দন চক্রবর্তী

সমস্যা তুলে ফ্ল্যাটটা নিয়ে। দু’টো ঢাউস রুম। একটা বড়-সড় রান্নাঘর, কাবার্ড। চিমনি-টিমনি লাগানো। মাঝে চৌকোব বড় ডাইনিং কাম বসার ঘর। দু’টো ঘরের সঙ্গে দক্ষিণমুখো ব্যালকনি। দুটো রুমে অ্যাটাচড টয়লেট। একটা বড় ঝিরঝিরে শাওয়ার-টাওয়ার লাগানো টয়লেট। মোট হাজার স্কোয়ার ফুটের। রত্না রাহুলের ফ্ল্যাট, তিনতলায়। লিফট আছে। কমপ্লেক্সে আরও অনেক ফ্ল্যাট আছে। ডু-প্লেক্স, থ্রি-প্লেক্স ইত্যাদি সব ব্যাপার-স্যাপার। গেটে পালা করে সিকিউরিটি গার্ড আছে। জায়গাটাও ভালো। বাইপাসের ধারে। সেই ফ্ল্যাটটা কেনা হয়েছে দু’জনের পয়সায়। দু’জনেই ভাল চাকরি করে। অতএব অসুবিধে হয়নি।

ফ্ল্যাটটা এখন দুজনের। রত্না মিত্র, রাহুল মিত্রের নামে। দু’জনের মধ্যে এখন ভদ্রলোকি চুক্তি হয়েছে। যে তাড়াতাড়ি অপরের টাকা শোধ করে দিতে পারবে তার নামে ফ্ল্যাটটা রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে। দু’জনেরই টার্গেট ফ্ল্যাটটা।এত ভাল পজিশনে ফ্ল্যাট পজেজ করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অতএব যতদিন না তা সম্ভব হচ্ছে ততদ্দিন কিচ্ছু করার নেই। রত্না চোখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “তা বললে তো হবে না? অনন্তকাল এক ফ্ল্যাটে তোমার মত থার্ড ক্লাস লোকের সঙ্গে ঘর করা অসম্ভব।” রাহুল ক্ষাপা। “আমার তো তবুও ক্লাস আছে। তুমি তো ক্লাসলেশ। ক্লাসলেশের সঙ্গে আমারও থাকা সম্ভব নয়।”

সংলাপ ।। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

ইন্ডাস্ট্রির কেউই  ভাল বুঝতে পারল না ফ্লপ পিরিয়ড পিস রিলিজ়ের দেড়মাসের ভিতর শৈবাল রায় কীভাবে আবার নতুন ছবি তৈরির রসদ জোগাড় করে ফেললেন। এবারের ছবি, থ্রিলার আর আউটডোর হবে দার্জিলিং ও সিকিমে। শুটিংয়ের ডেট ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লোকেশন দেখে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টটাই গুবলেট করে দিল সব। ভোরের ঘন কুয়াশায় একটা গাছে ধাক্কা মেরে ঢাল বেয়ে অনেকটা চলে যায় এসইউভি। স্থানীয় একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাথায় আটটা স্টিচ হয় শৈবাল রায়ের। রাতে কলকাতায় ফিরেই একটা হাই-ফাই প্রাইভেট হসপিটালে ভর্তি হয়ে শৈবাল জানতে পারেন যে প্রচুর ব্লাড-লস হয়েছে বলে ওঁকে রক্ত নিতে হবে। উনি ওই অবস্থাতেই মিডিয়াতে ওঁর বন্ধুদের ব্যাপারটা জানিয়ে একটা স্টোরি করতে অনুরোধ করেন আর এক্সক্লুসিভ কেবিনে শুয়ে স্যালাইন-স্ট্যান্ড থেকে ঝোলা রক্তের বোতলটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন এই ঘটনাটা কাগজে বেরোলে যে সিমপ্যাথি পাবেন, তা পরের ছবিটাকে হিট করাবেই…

ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটে।

শ্যালক সংশ্লেষ || বিপুল মজুমদার

অঙ্ক স্যারের কাছে টিউশন পড়ে ফেরার পথে রাস্তায় দুই বন্ধুতে জোর তর্কাতর্কি। দু’জনেই ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। সমীরের বক্তব্য, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বয়সে বড়। চন্দনের এতে প্রবল আপত্তি। সে বলছে রাহুল গাঁধী। শেষপর্যন্ত বিতর্কটা বাজির দিকে গড়িয়ে গেল। ঠিক হল, যে হারবে, সে জয়ীকে চারখানা রসগোল্লা খাওয়াবে। বাজির শর্ত চূড়ান্ত হতেই দু’জনে আর সময় নষ্ট করল না। সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তার ধারের এক সাইবার ক্যাফেতে ঢুকে পড়ল। সেখানে মালিক লোকটিকে পটিয়ে-পাটিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দু’মিনিটের মধ্যেই জেনে ফেলল, সত্যিটা কী। প্রিয়ঙ্কা নয়, রাহুল গাঁধীই বড়। রাহুলের জন্ম ১৯৭০-এ আর প্রিয়ঙ্কার ’৭২-এ।

বাজি জিতে উল্লসিত চন্দনের যেন আর তর সয় না। সে রসগোল্লা খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করায় সমীর বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। রসগোল্লা খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট রেস্ত নেই তার পকেটে। শেষে বন্ধুর জোরাজুরিতে অতিষ্ঠ হয়ে সে বলে উঠল, “কথায় আছে না, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন? আমারও তেমনই একটা গোপন ব্যাপার আছে, লাগে মিষ্টি, দেবে মোহন সেন! এমন একটা মিষ্টির দোকানে তোকে নিয়ে যাব, যেখানে রসগোল্লা কেন, ইচ্ছে হলে মুফতে তুই যা খুশি খেতে পারবি!”

মিথ্যুক ।। স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

“মিথ্যুক, তুই এক নম্বরের মিথ্যুক! আর কোনওদিন আমার সঙ্গে কথা বলবি না। কোনওদিনও না। বুঝলি?” পর্ণিকা এমন চেঁচিয়ে কথাটা বলল যে, ক্যান্টিনের সববাই পরিষ্কার শুনতে পেল। আমি দেখলাম, একশোটা চোখ আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! সত্যি, এমন সার্টিফায়েড মিথ্যুক তো দেখা যায় না খুব একটা!

আমি পর্ণিকাকে বললাম, “আরে, তুই রাগ করছিস কেন? পুরো ব্যাপারটা শোন!” “না শুনব না, কিচ্ছু শুনব না। মিথ্যেবাদী একটা! জোচ্চোর! আজ ঠিক দু’মাস দশ দিন হল। দু’মাস দশ দিন। কই হল কিছু? এমন একটা ব্যাপারেও তুই মিথ্যে বললি? ছিঃ।” ‘ছিঃ’ একটা জোরদার শব্দ। আট অক্ষরের গালাগালিও যে ইমপ্যাক্ট আনতে পারে না, এই ছোট্ট দেড় বা দু অক্ষর আরামসে তার দশগুণ ধাক্কা এনে দেয়!

আমি চারিদিক দেখে নিয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে আরও কিছু বোঝাতে গেলাম। কিন্তু পর্ণিকা আর শুনলই না কিছু। গটগট করে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে।

আমি সামনের অ্যানিমিক রোগীর মতো পাঁউরুটির টুকরো দুটোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যেটুকু খিদে ছিল ঝাড় খেয়ে মিটে গিয়েছে!

Smaranjit Chakraborty Book, Smaranjit Chakraborty New EBook, Smaranjit Chakraborty Latest Pdf, Smaranjit Chakraborty Book, Smaranjit Chakraborty Latest EBook, EBook, Latest Ebooks, New Bangla EBook, Bangla Latest Pdf, New Smaranjit Chakraborty Pdf, Free Download Smaranjit Chakraborty Boooks, Smaranjit Chakraborty Book Collection, Smaranjit Chakraborty Free Download EBook, Latest Book By Smaranjit Chakraborty !!! Thanks to Original uploader.